শামসুল আরেফীন
শামসুল আরেফীন (জন্ম ২০ নভেম্বর, ১৯৭৭) বাংলাদেশি লোকগবেষক, গীতিকার ও কবি। তিনি ২০২৪ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক একুশে সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন।
শিক্ষা ও কর্মজীবন : আরেফীন ১৯৭৭ সালের ২০ নভেম্বর চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার সদর এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আবদুল মোবিন ও মাতা তমনারা বেগম। চন্দনাইশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তার প্রাথমিক শিক্ষা জীবনের শুরু হয়। চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও গাছবাড়িয়া সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিলস লিমিটেড ও সেভ দ্য চিলড্রেন-এর শিখন প্রোগ্রামে চাকরি করেন এবং বর্তমানে চট্টগ্রামের প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটিতে সহকারী জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
লেখালেখি ও গবেষণা : শামসুল আরেফীন নব্বই দশকের প্রথমে পত্র-পত্রিকায় ছড়া-কবিতা লিখতে শুরু করেন। নব্বই দশকে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক দৈনিক, সাহিত্যপত্রিকা, বিভিন্ন শিশুতোষ পত্রিকা ও ছড়াসংকলনে তাঁর ছড়া ও কিশোর কবিতা প্রকাশিত হয়। তিনি নব্বই দশকের মাঝামাঝি লোকগবেষণায় সম্পৃক্ত হয়ে বিলুপ্ত ও বিস্মৃতপ্রায় লোককবি ও তাদের রচনা উদ্ধারে নিয়োজিত হন। মুন্সী আমিন শরীফ, মোরশেদ চাঁদ দরবেশ, দলিলুর রহমান পণ্ডিত, আবদুল জব্বার মীমনগরী, আবদুস সবুর মাখন, গোলাম গণি চৌধুরী, সাইদ মিয়া, আবদুল আজিজ পণ্ডিত, আবদুল খালেক, ক্ষেমেশ চন্দ্র রক্ষিত, আব্দুর রশিদ, আফতাব উদ্দিন, আবদুল লতিফ শাহ্, আবদুল্লাহ বাঞ্জারামপুরী, মকবুল আহমদ পণ্ডিত, মোজহেরুল আলম ওরফে ছাহেব মিয়া, বজলুল করিম মন্দাকিনী, শেখ মোহাম্মদ নিজামুদ্দিন, কাজল শীল, বাদশা আলম, ফকির ইয়াছিন শাহ্, হেফাজতুর রহমান খান, আতিকউল্লা শাহ্, করিম শাহা, শাহ্ আবদুল জলিল সিকদার, আমানুল্লাহ, আতর আলী, আবুল খায়ের নক্সবন্দি, ঈছা আহমেদ নক্সবন্দি, খাদেম আলী, আলী রজা ওরফে কানুফকির এবং আবদুল গফুর হালী প্রমুখ লোককবির পরিচয় ও বর্ণনা আরেফীনের রচনায় ও গ্রন্থে খুঁজে পাওয়া যায়।
শামসুল আরেফীন লোকগবেষক হিসেবে পরিচিত হলেও তাঁর প্রথম গ্রন্থ আহমদ ছফাকে নিয়ে। গ্রন্থটির নাম ‘আহমদ ছফার অন্দরমহল’।২০০৪ সালে চট্টগ্রামের বলাকা প্রকাশন থেকে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ এই প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয় ২০২০ সালে।তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় হাওলাদার প্রকাশনী-ঢাকা থেকে ২০২১ সালে।আহমদ ছফার জীবন, সাহিত্য ও বেশকিছু চিঠি এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।‘আহমদ ছফার অন্দরমহল’ গ্রন্থের মাধ্যমে আরেফীন আহমদ ছফার জীবনচরিতকার হয়ে উঠেন।এই গ্রন্থে আহমদ ছফার জীবনকাহিনী পুননির্মাণ করার এবং তাঁর চিঠির সংকলন করে তাঁর মানসপ্রকৃতি উদঘাটনের চেষ্টা করা হয়েছে।এছাড়াও আহমদ ছফার অনেক মানবিক ঘটনাবলী ও তাঁর জেলজীবন তুলে ধরা হয়েছে।
গ্রন্থতালিকা : লোকগবেষণাসহ বিভিন্ন বিষয়ে শামসুল আরেফীনের আজ অব্দি প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ২২। গ্রন্থগুলো হলো।
পুরস্কার ও সম্মাননা : শামসুল আরেফীন প্রবন্ধ (গবেষণা) শাখায় অবদানের জন্য ২০২৪ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক একুশে সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন।
তাঁর প্রাপ্ত অন্যান্য পুরস্কার
আস্কর আলী পণ্ডিত পদক-২০১১,
শুভেচ্ছা স্মারক: দরিয়ানগর কবিতামেলা-২০১২,
চট্টগ্রাম নবকুঁড়ি পদক-২০১৫,
আহমদ ছফা সম্মাননা-২০১৫,
আলী রজা সাহিত্য সম্মাননা-২০১৯।
কাউয়া আঞ্চলিক গান নিয়ে সমালোচিত
চট্টগ্রামের লোকগানের একটি শাখা হলো কাউয়া আঞ্চলিক গান। শব্দবন্ধটি এখন বিলুপ্তপ্রায়। আরেফীন তাঁর লেখনীর মাধ্যমে চট্টগ্রামের কাউয়া আঞ্চলিক গানের কথা তুলে ধরে সমালোচিত হন। তিনি তাঁর 'প্রধানমন্ত্রীর সহায়তায় বাঁচতে পারেন সৈয়দ মহিউদ্দিন', 'চট্টগ্রামের কাউয়া আঞ্চলিক গান', 'আস্কর আলী পণ্ডিতের চাটগাঁইয়া গান', 'সৈয়দ মহিউদ্দিনের প্রস্থান' প্রভৃতি প্রবন্ধের মাধ্যমে কাউয়া আঞ্চলিক গানের কথা তুলে ধরে সমালোচনার জন্ম দেন। তিনি তাঁর চট্টগ্রামের লোকসংগীত গ্রন্থেও কাউয়া আঞ্চলিক গানের কথা উল্লেখ করেন। বিশেষ করে চট্টগ্রামের সাহিত্যিকদের অনেকে 'কাউয়া আঞ্চলিক গান' শব্দবন্ধকে অপমানসূচক মনে করেছেন। শামসুল আরেফীন লিখেছেন:
বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে আঞ্চলিক ভাষার মিশ্রণে পুঁথি রচনার একটি রীতি লক্ষণীয়। এরপরও অর্থাৎ উনিশ ও বিশ শতকেও এই রীতি অনুসরণ করে অনেকে পুঁথি লিখেছেন। উনিশ-বিশ শতকে আস্কর আলী পণ্ডিত (১৮৪৬-১৯২৭) রচিত পুঁথিতেও এই রীতি লক্ষ্যগোচর হয়। পুঁথির মতো বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের গানেও এই রীতি রয়েছে। আঠারো শতকের কবি আলী রজা ওরফে কানুফকির (১৭৫৯-১৮৩৭) এই রীতি অনুসরণ করে অর্থাৎ চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার শব্দ প্রয়োগ করে গান লিখেছিলেন। আস্কর আলী পণ্ডিতের গানেও এই রীতিই অনুসরণ করা হয়েছে। এ ধরনের গানকেই চট্টগ্রামে ‘কাউয়া আঞ্চলিক গান’ বলা হতো।[৬