আরেফিন-বাদল
ব্যতিক্রমি ধারার একজন সফল কথাসাহিত্যিক আরেফিন বাদল (জ. ১৯৪৮)। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, নাটক কিংবা গবেষণা-প্রবন্ধসহ সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখায় তাঁর মুক্ত লেখনি- প্রতিনিয়ত আমাদের চিন্তার পরিসরকে করে শাণিত ও সমৃদ্ধ। সম্পাদক ও সাংবাদিক হিসেবেও তাঁর রয়েছে ঈর্ষণীয় ভূমিকা। তাঁর গ্রন্থসমূহ পাঠে যেটুকু উপলব্ধি করতে পেরেছি, তাতে একথা নিশ্চিত করেই বলা যায়, বহুমাত্রিক লেখক আরেফিন বাদল বাংলা ভাষা-সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ।
আরেফিন বাদলের লেখালেখি শুরু ষাটের দশকে। সত্তর দশকে তাঁর বিকাশ এবং খ্যাতি। এ সময়েই একজন সচেতন মানুষ হিসেবে স্বাধীনতা পরবর্তী যাপিতজীবনের হতাশা, মূল্যবোধের অবক্ষয়, সমাজের নানা অসংগতি, শ্রেণি-সংগ্রাম, সংক্ষুব্ধ গণমানুষের আবেগ, বিভিন্ন পীড়াদায়ক ঘটনা এবং মনের একান্ত ভাবনাগুলো তিনি কথাসাহিত্যের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। লেখার স্রোতধারায় এখনও তিনি নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন সমান উচ্চতায়।
আরেফিন বাদল তাঁর মেধা, প্রতিভা, উদ্ভাবনী চিন্তা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক পরিচিতিকে কাজে লাগিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশের প্রথম রঙিন বিনোদনমূলক পত্রিকা পাক্ষিক ‘তারকালোক', মাসিক ‘কিশোর তারকালোক’, সাপ্তাহিক ‘আগামী’ ও মাসিক ‘তারকালোক ডাইজেস্ট’, সাহিত্য পত্রিকা ত্রৈমাসিক বালার্ক ও তারকালোক কার্টুন সিরিজ। সবগুলো পত্রিকার তিনি প্রতিষ্ঠাতা, সম্পাদক ও প্রকাশক। পত্রিকাগুলোতে তিনিই প্রথম বাংলা ভাষায় বাণিজ্যিকভাবে বাংলা লিপি (DTP)'র ব্যবহার শুরু করেন (১৯৯৭)।
কর্মজীবনে তিনি বিভিন্ন দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকা এবং সংবাদ সংস্থায় সাংবাদিকতা ছাড়াও সরকারি চাকরিসূত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পত্রিকা পাক্ষিক ‘প্রতিরোধ’ ও বাংলাদেশ স্কাউট-এর মুখপত্র মাসিক ‘অগ্রদূত’-এর সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘদিন।
আরেফিন বাদল-এর উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ : ‘প্রসবোন্মুখ যন্ত্রণাবিদ্ধ’ (১৯৭৮), ‘আগামীকাল ভালোবাসার’ (১৯৮০), ÔShort storiesÕ (১৯৮১), ‘অন্তুর বর সাজা’ (১৯৯০), ‘নিত্যদিন কালগোনা’ (২০০৪), ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প’ (২০১০), ‘গল্প সমগ্র’ (২০১৮), বিশ শব্দের গল্প’ (২০২০)। একমাত্র কিশোর গল্প : ‘অন্তুর বর সাজা’ (১৯৯০)। আরেফিন বাদলের গল্পগুলোতে বৈচিত্র্যময় বিষয় স্থান পেয়েছে। জীবনঘনিষ্ঠ এসব গল্পে, গণমানুষের যাপিত জীবন, সমাজ জীবনের নানা অসংগতি, যুগে যুগে সংঘটিত সফলতা-ব্যর্থতা, মুক্তিযুদ্ধের নানা পীড়াদায়ক ঘটনা, বাংলা-বাঙালিন নানা বঞ্চনার বিষয় ইত্যাদি গল্পের কাহিনিকে করেছে প্রভাবিত, যা লেখকের বস্তুবাদী চিন্তার সোনালি ফসল।
উপন্যাস : ‘নিসর্গের সন্তানেরা’ (১৯৮১), ‘ইমুবাবু’ (১৯৯৮), ‘ঐ আসে আমিরালী’ (১৯৯৯), ‘সারা’র ব্রীজ’ (১৯৯৯), ‘হাকিম উদ্দিন তরফদার’ (২০০১), ‘অতঃপর একটি স্যুটকেস’ (২০১৭), ‘উপন্যাস সমগ্র’ (২০১৮), ‘এবং মাতৃত্ব’ (২০১৯)। এসব উপন্যাসের মূলসুর- মাটি, মানুষ, মানবতা। বস্তুত খণ্ডবিখণ্ডিত নিষ্পেষিত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম জাতি- বাঙালির কল্যাণবোধে উদ্ধুদ্ধ এবং একক সত্তায় মিলিত হওয়ার স্বপ্নে বিভোর তিনি।
কথাসাহিত্যের বাইরে তাঁর গবেষণা ও অন্যান্য গ্রন্থ : ‘ঐতিহাসিক প্রেমপত্র’ (১৯৭৬, ৩য় সংস্করণ), ‘মওলানা ভাসানী’ (১৯৭৭, ২য় সংস্করণ), ‘রবীন্দ্রনাথের জীবনে নারী’ (১৯৯৯, ২য় সংস্করণ), ‘চাষী-মজুরের মওলানা ভাসানী’ (২০২২), ‘বাংলাদেশ-ভারত কনফেডারেশন : একাত্তরে ইন্দিরাকে ভাসানীর চিঠি’ (২০২৩)।
টিভি নাটক : ‘কাছের মানুষ কাঁদে’ (১৯৮৯), ‘ঐ আসে আমিরালী’ (১৯৮৯), ‘ইমুবাবু’ (১৯৯৭), আপন অস্তিত্বে’ (২০০৭), ‘নেতা ঘেমে যাচ্ছেন’ (২০০৮) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, এদেশে বেসরকারিভাবে নির্মিত প্রথম টিভি অনুষ্ঠানÑ(প্যাকেজ নাটক) ‘প্রাচীর পেরিয়ে’-এর নির্মাতা ও প্রযোজক তিনি (১৯৯৪)।
এছাড়া আরেফিন বাদল-এর বর্ণাঢ্য ‘জীবন ও কর্ম’ নির্ভর বিচিত্রধর্মী বিভিন্ন গুণীজনের তথ্যবহুল লেখা নিয়ে টাঙ্গাইল সাধারণ গ্রন্থগার থেকে সবুজ মাহমুদ-এর সম্পাদনায় ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছে প্রায় ছয়শত পৃষ্ঠার ‘আরেফিন বাদল সংখ্যা : ‘যমুনা’ গ্রন্থটি। এই বইটিকে বিগত ৫০/৬০ বছরের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সমকালীন বিভিন্ন প্রসঙ্গের নির্মোহ বিশাল তথ্যভাণ্ডারও বলা চলে।
আরেফিন বাদল মুক্তিযুদ্ধের মাঠ পর্যায়ের একজন সক্রিয় সংগঠক। সর্বোপরি সফল মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতায় নিজেকে সমৃদ্ধ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তৎকালীন রাজনীতির জটিল ঘূর্ণাবর্তে আবর্তিত হয়েছেন কিন্তু কোনো বিশেষ মতাদর্শে আবদ্ধ থাকতে পারেননি। কারণ, তিনি মানুষের অন্তর্লোকে ডুবে গিয়ে মানুষের দুঃখযন্ত্রণার উৎসমুখ অনুসন্ধান করেছেন। মূলত লেখালেখির মাধ্যমেই সামাজিক অবস্থাÑমানুষের মনোগত সমস্যা তুলে ধরে একটা নির্মল মানবিক সমাজ সৃষ্টির নিরন্তর প্রত্যাশা জিইয়ে রেখেছেন।
আরেফিন বাদল তার নানামুখী কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘ভাসানী পদক’ (১৯৮৭), ‘ময়মনসিংহ সাহিত্য ও সংস্কৃতি পুরস্কার’ (২০০৬), বাচসাস কর্তৃক বাংলাদেশে বিনোদন সাংবাদিকতায় ‘বিশেষ সম্মাননা’ (২০১২), চ্যানেল আই কর্তৃক ‘ফজলুল হক স্মৃতি পুরস্কার’ (২০১৪), ‘বাচসাস চলচ্চিত্র পুরুস্কার : ওবায়েদ-উল হক স্মৃতি পদক’ (২০১৪), ‘টাঙ্গাইল সাহিত্য সংসদ পুরস্কার’ (২০১৬), ‘আনন্দ আলো সম্মাননা’ (২০১৬) ভাসানী পরিষদ কর্তৃক ‘বিশেষ সম্মাননা পদক’ (২০২২)-সহ দেশি-বিদেশি বহু পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন।
দেশপ্রেমের উজ্জ্বল উদাহরণ আরেফিন বাদল কোনোরকম মোহ ছাড়াই দেশ ও মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন এবং করে যাচ্ছেন। বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাজে তাঁর সেবাধর্মী পৃষ্ঠপোষকতা আমাদেরকে আশান্বিত করে। বলা যায়, সৃজনচিন্তার এক ফলবান বৃক্ষ তিনি। সাহিত্যশিল্পের নানা শাখায় তাঁর সম্পৃক্ততা আজও পরিলক্ষিত হয়। তিনি ভাসানী গবেষণা প্রকল্পের ‘প্রকল্প প্রধান’, ‘সময়ের সাহিত্যকণ্ঠ’ পত্রিকার প্রধান পৃষ্ঠপোষক, বাচসাস-এর জীবন সদস্য ও বাংলা একাডেমির ‘জীবন সদস্য’।
প্রচুর লিখে জনপ্রিয় হওয়ার আকাক্সক্ষা আরেফিন বাদলের কখনোই ছিল না। তিনি নিজের অভিজ্ঞতা আর বিশ্বাসের জায়গা থেকে সমাজবাস্তবতার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখেছেন, যা পাঠকের মর্মমূলে স্পর্শ করেছে। নানা প্রতিকূল পরিস্থিতি ও সংকটেও নিজের আদর্শের প্রতি সৎ থাকার প্রচেষ্টা তাঁকে করেছে আরও মহিমান্বিত, উজ্জ্বল। সুস্থ-সবল দেহে আরও দীর্ঘকাল তিনি বেঁচে থাকুন আমাদের মাঝে- এই প্রত্যাশা করি।
আরেফিন বাদল ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ২৫শে সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইল জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি ঘাটাইলের পোড়াবাড়ি গ্রামে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে’ ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ২৫ শে সেপ্টেম্বর তাঁর ৭৭তম জন্মদিন।